বর্তমানকালের মতো সে যুগেও হিন্দুরা বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি-নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান পালন করতো। আড়ম্বর ও জাঁকজমকের সঙ্গে হিন্দুরা বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করতো। এর মধ্যে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, শিব, শিবলিঙ্গ, চণ্ডী, মনসা, বিষ্ণু, কৃষ্ণ, সূর্য, মদন, নারায়ণ, ব্রহ্ম, অগ্নি, শীতলা, ষষ্ঠী, গঙ্গা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । বাঙালি হিন্দুরা সামাজিক জীবনে দুর্গাপূজা, দশহরা, গঙ্গা স্নান, অষ্টমী স্নান এবং মাঘী সপ্তমী স্নানকে পবিত্র বলে মনে করতো। ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের নিকট গঙ্গাজল অত্যন্ত পবিত্র। তারা দোলযাত্রা, রথযাত্রা, হোলি ইত্যাদি ধৰ্মীয় উৎসব পালন করতো। ধর্মীয় ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় প্রাচীন বাংলার সময়ের ন্যায় এ যুগেও অপরিসীম কর্তৃত্বের অধিকারী ছিল। ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা ধর্ম-কর্ম পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করতেন।
জাতিগত শ্রেণিভেদ ছাড়াও হিন্দু সমাজে কতকগুলো ধর্মীয় সম্প্রদায় ছিল। যেমন- শৈব, শাক্ত ইত্যাদি। হিন্দু জাতির মধ্যে এ সময় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবও উল্লেখযোগ্য ছিল। এ সময়ে হিন্দু সমাজের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা। মুসলমানরা বর্তমান সময়ের মতোই মধ্যযুগেও বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি-নীতি ও আচার অনুষ্ঠান পালন করতো। ঈদ- উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা মুসলমান সমাজের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালিত হতো। ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্রই পবিত্র রমজান মাসে রোজা রাখতো। এছাড়াও শব-ই-বরাত ও শব-ই-কদরের রাতে ইবাদত-বন্দেগি করতো। উৎসব অনুষ্ঠানে মুসলমানরা তাদের সাধ্যমতো নতুন এবং পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে একে অন্যের গৃহে গিয়ে কুশল ও দাওয়াত বিনিময়ের মাধ্যমে তাদের সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বভাবকে সুদৃঢ় করতো । সুলতান, সুবাদার ও নবাবগণ ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে জনগণের সান্নিধ্যে আসতেন। বিশেষ আড়ম্বরের সঙ্গে মুসলমানরা মহানবির (সা.) জন্মদিন পালন করতো। বর্তমান সময়ের মতো মধ্যযুগেও মহরম উৎসব পালিত হতো। এটি শিয়া সম্প্রদায়ের একটি প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলে পরিচিত। এ উদ্দেশ্যে শিয়ারা 'তাজিয়া' তৈরি করত। মুসলমানদের বর্ষপঞ্জি অনুসারে মহরমের প্রথম দিনকে নববর্ষ হিসেবে পালন করা হয় । মহরমের চন্দ্র উদয়কে মুসলমানরা আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে বরণ করত ।
এ যুগে ধর্মপ্রীতি মুসলমান সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল । ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। এছাড়া তারা নিয়মিত কোরআন ও হাদিস পাঠ করতো। সমাজে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। ছেলে-মেয়ে উভয়কেই ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য মক্তবে পাঠানো হতো। সমাজে ধর্মীয় জ্ঞানের জন্য এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পরিচালনার জন্য মোল্লা সম্প্রদায়কে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো । গ্রামীণ জীবনে ধর্মীয় উৎসব এবং বিয়েশাদির মতো সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে মোল্লা সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য ।
মুসলমান সমাজে সুফি ও দরবেশ নামে পরিচিত পির বা ফকির সম্প্রদায়ের যথেষ্ট প্রভাব ছিল । তাঁরা ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন এবং সর্বদা আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন । দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁরা ধর্ম সাধনার জন্য ‘দরগা' প্রতিষ্ঠা করেন । শাসকবর্গ ও জনগণ সকলের কাছেই তাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। বাংলায় ইসলামের বিস্তৃতির সাথে সাথে মুসলমান সমাজও বিস্তৃত হতে থাকে। বাংলায় মুসলমান সমাজে দুইটি পৃথক শ্রেণি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। একটি বিদেশ থেকে আগত মুসলমান, অন্যটি স্থানীয় ভাবে ধর্মান্তরিত মুসলমান। বিদেশি ও স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে কৃষ্টি ও রীতিনীতির পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দেয়নি। মুসলমান শাসকদের উদারতা এবং স্থানীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতাই এর কারণ ছিল ।
আরও দেখুন...